সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরছে অভি, বুক পকেট থেকে ফোনটা বেজে উঠলো। ক্লান্তির আঙুলে পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলো সোমার ফোন। সারাদিন কাজের চাপে ব্যস্ত অভি আজ সোমাকে ফোন করার সময়ই পায়নি, দেখে বেশ কিছুটা খুশীই হল সে। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে "কিগো, সারাদিন একটা ফোনও করলে না, এতো ব্যস্ত তুমি আজকাল..."। একটা নিঃশ্বাস ফেললো অভি, তার কাছে এই অভিযোগ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তারপর বলল, "বুঝতেই তো পারছ বাইরে কাজে এসেছি, এখানে খুব চাপ তাই আর সময় পাইনি আর কি..."। সোমা কিছুটা ভারী গলায় বলল, "নিজের কাজ নিয়েই থাকো, তোমার স্যার তো আর কাউকে পায় না, সব তোমাকেই দিতে হয়... একটা নতুন ফ্ল্যাট দেখেছিলাম আমরা দুজন থাকবো বলে, সে বিষয়েই কথা বলতাম। থাক, রাখছি!" অভি জানে প্রতিদিনের মতো আজও তার কিছু বলার নেই, ও নিজের কাজটাকে খুব ভালবাসে তাই যত অসুবিধাই হোক খুব আনন্দ সহকারে কাজগুলো শেষ করে। ফোনটা পকেটে ভরে চুপচাপ হাঁটতে শুরু করে অভি, সামনেই অটো স্ট্যান্ড, প্রতিদিন সেখান থেকে অটো ধরে বাড়ি ফেরে। রাস্তার একদম ধারেই একটা বাড়িতে ভাড়া থাকে, তার আসল বাড়ি ও অফিস দুই-ই কলকাতায়, কর্মসূত্রে মুম্বইয়ে চারদিনের জন্য এসে এখানেই ভাড়া উঠেছে। কাল সকালের ফ্লাইট। আজ অভির মনে বেশ কিছু ভাবনা জড়ো হয়েছে। সারাদিন কাজের ব্যস্ততায় যে ভাবনাগুলো চাপা পরে থাকে প্রতিদিন, আজ সেগুলো খুঁড়ে আনবে মনের পৃষ্ঠায়, তাই সন্ধ্যার বাতাসে নিজের মনকে ভাসিয়ে দিয়ে এই অচেনা শহরের পথের উপর দিয়ে হেঁটেই ঘরে ফিরতে চায় সে, কালই তো ছেড়ে চলে যাবে। অভি এগিয়ে যেতে লাগলো, ১০ মিনিট হেঁটে এগোনোর পরই সামনে একটা ছোট ব্রিজ, দুদিকে রেলিং দেওয়া আর নীচ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট একটা খাল। প্রতিদিন অটো করে সাঁ সাঁ করে এই ব্রিজের বুকের উপর দিয়ে ঘরে ফিরে যায় অভি। আজকে সে থমকে একটু দাঁড়ালো। ব্রিজের রেলিং-এ হেলান দিয়ে নীচের দিকে তাকাল, জল বয়ে যাচ্ছে কুল কুল শব্দে আর অন্ধকারে ঘনীভূত হয়ে উঠেছে চারপাশটা। সারাদিন অফিসের ক্লান্তির পর যেন এখানে জলের শব্দে নিজের সমস্ত ক্লান্তিকে ভাসিয়ে দিতে পারছে সে। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে অভির মন যেন হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়া কোনও বহুদিনের চেনা পরিসরে ঢুকে পড়েছে। অভির মনে পড়লো আজ দুপুরে টিফিন করা হয়নি কাজের চাপে, অবশ্য তাতে কার কি, কেউ খোঁজও তো নেয়নি তার। আর নেবেই বা কেন, সে এখন স্বাবলম্বী। এককালে কেউ অবশ্য প্রতিদিন ফোন করে খোঁজ নিত তার। একটা জোড় নিঃশ্বাস ফেললো, চোখটা কিছুটা ঝাপসা হয়ে এলো। চোখ মুছে অভি তাকাল দূরের দিকে, ল্যাম্পপোস্টগুলো কেমন একভাবে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে আর অবিরাম আলো দিয়ে চলেছে রাস্তার বুকের ক্ষতগুলোতে। প্রতিদানে কিছুই পায়না, আলো কমে এলে লোকজনের গাল খায়। এভাবেই ঝড় বৃষ্টি মাথায় রেখে আলো দিয়ে চলে তারা। হাতঘড়িটার দিকে তাকাল, অন্যদিনের তুলনায় রাত হয়েছে বেশ, তাতে কি, চিন্তা করার কেউ নেই বাড়িতে। আবার ফোনটা বেজে উঠলো, বের করে দেখল মায়ের ফোন। প্রতিদিন রাত্রের মতো আজও তিনি সেই চেনা সুরেই বললেন "কিরে, ঘরে ফিরেছিস? খেয়েছিস কিছু?" প্রতিদিন অভি বিরক্ত হয়ে বলে "ধুর, আমি কি বাচ্ছা নাকি, এসব জিজ্ঞেস করবে না তো প্রতিদিন!" অভির মা হেসে ওঠেন জবাব শুনে। আজকে অভি শান্ত স্বরে বলল "হ্যাঁ মা ফিরেছি, একটু পরেই খাবো"। অভি জানে এখনও ঘরে ফেরেনি শুনলে তার মা চিন্তা করবেন তাই মিথ্যে কথাটাই বলতে হল। তারপর কিছুক্ষণ চলল মা-ছেলের কথোপকথন। ফোন রাখার সময় অভির মা বলল "মায়েদের চোখ কখনো ফাঁকি দেওয়া যায় রে! তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে কিছু খেয়ে নিস! কাল সকালের ফ্লাইট তো, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়িস" অভি হতবাক, এভাবে কেউ কোনোদিন ওর মন পড়তে পারেনি আগে। ঘরে ফিরে এসে খাওয়াদাওয়া করে ঘড়িতে অ্যালার্মটা সেট করে ঘুমিয়ে পড়লো অভি। সকালে উঠে সোমার ফোন, কথা বলে তারপর রেডি হয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে রওনা হল এয়ারপোর্টের দিকে। ফ্লাইট ধরল সে, কলকাতায় ল্যান্ডিং ১০ টায়। ল্যান্ড করার সময় হঠাৎ ভীষণ ঝাঁকুনি, একটা জোড় বিস্ফোরণ। তারপর... লাফিয়ে উঠলো অভি, "কি ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্ন!"
ঘড়ির দিকে তাকাল, সময় ভোর ৫টা, সকাল ৮টা ১৫-য় ফ্লাইট। সোমার ফোন এলো, "কি গো উঠেছ? আমি ১১ টায় তোমার জন্য কলকাতা এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করবো কিন্তু, নেমে একটা ফোন করো আমায়, তারপর একসাথে আমরা নতুন ফ্ল্যাট-টা দেখতে যাবো। যেখানে আমি আর তুমি থাকবো অনলি..." অভি কথা না বাড়িয়ে "হুম..." বলে রেখে দিলো। অভির মনে পড়লো কেউ একজন বলেছিল ভোর রাতের স্বপ্ন কিন্তু সত্যি হয়, অভির কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল মনের ভিতর, সবাইকে হঠাৎ করে দেখতে ইচ্ছে করছিলো, কিন্তু উপায় কই! বাড়ি না ফিরলে তো দেখতে যেতে পারবে না। তাই উপায় না পেয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে ট্যাক্সি ধরে বেড়িয়ে পড়লো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। ফ্লাইট ধরল অভি। সোমা যথারীতি ১১টার সময় এয়ারপোর্টে এসে দাঁড়িয়ে আছে অভির জন্য। হঠাৎ অভির ফোন, কানে দিতেই "আমি নেমেছি, গেট থেকে বেড়িয়ে পরেছি, সামনের ফাঁকা গলিটার দিকে এসো, ওখানেই অপেক্ষা করছি আমি..."। সোমা ফোনটা রেখে তাড়াতাড়ি ওদিকে গেল, অভিকে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরল। অভি সোমাকে বলল, "আজকে খুব ক্লান্ত, অন্য একদিন ফ্ল্যাটটা দেখতে যাবো, চলো ঘরে ফিরি..." সোমা শুনতেই চাইলো না, অভির উপর রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো "আমাকে তো আর ভালোবাসো না, আমার কথা রাখবে কেন, অফিসের কাজগুলোই তো মুল্যবান তোমার কাছে..." অতঃপর অভি রাজি হয়ে সোমার সাথে গেল নতুন ফ্ল্যাট দেখতে, সেখানে দুজনে ঘুরে ঘুরে ঘরগুলো দেখতে লাগলো। ফ্ল্যাট দেখে বাইরে এসে সোমা দেখছে অভি নেই, বেশ কয়েকবার নাম ধরে ডাকল, কিন্তু কেউ সারা দিলো না। বাইরের সিকিউরিটি গার্ডটা ছুটে এসে জিজ্ঞেস করলো "আপ কিসি কো ঢুন্ড র্যাহি হ্যায় ম্যাডাম?", সোমা উত্তরে দিলো "হ্যাঁ, মেরে সাথ জিসনে আয়ে থে, উনকো..." সিকিউরিটি গার্ড জবাবে বলল "লেকেন আপ তো আকেলাই আয়ে থি ম্যাডাম..." সোমা আর কথা না বাড়িয়ে ফোনটা বের করল অভিকে ফোন করবে বলে, ফোন বের করেই দেখল ৬-টা মিস্ কল অভির বাড়ি থেকে। সাইলেন্ট থাকায় ফোনটা শুনতেই পায়নি, কিন্তু অভি তো ফোন করলো তখন বাজলো! যাই হোক সে আর কথা না বাড়িয়ে ঘুড়িয়ে ফোন করলো বাড়িতে, অভির এক বন্ধু ফোনটা ধরে বলল "তুমি বাড়ি এসো খুব দরকার..." সোমা বলতে গেল "কিন্তু অভি তো..." ওমনি অপর প্রান্ত থেকে বলল "অভি পরে আসবে, তুমি তাড়াতাড়ি এসো..."। সোমার মাথা গরম, অভি না বলে নিশ্চয়ই আবার অফিসের কাজে চলে গেছে। ট্যাক্সি ধরে যখন ঘরে ফিরল সোমা, বাড়ির বাইরে অনেক লোকজন জড়ো হয়েছে। ঘরে ঢুকে অভির সেই বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলো, "কি হয়েছে, বাইরে এতো...?" সে সোমার কাঁধে হাত রেখে বলল "অভির ফ্লাইটটা ল্যান্ড করার সময়..." আর বলতে পারলো না, কেঁদে ফেললো সে। টিভির দিকে তাকাতেই সোমা দেখল খবরে প্লেন দুর্ঘটনার খবর, সোমার আর বুঝতে বাকি রইলো না ঘটনাটা। একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল সোমার গা বেয়ে, ভয় আর বেদনায় জর্জরিত হয়ে পড়লো সোমার মন। মনে পড়লো তার ঠাকুমার কাছে শুনেছিলো, ইহলোক ত্যাগ করার পূর্বে তার কাছের মানুষকে দেখা দিয়ে যায়... এয়ারপোর্টের পাশের ফাঁকা গলিতে দাঁড়িয়ে চিৎকারের শব্দগুলো বুকে এসে গাঁথতে লাগলো সোমার... হাতের কাছে ফোনটা আবার ভাইব্রেট করে উঠলো, এয়ারপোর্টের নাম্বার। অভির দেহ সনাক্ত করতে হবে।
No comments:
Post a Comment