রাহুলের খুব হতাশ লাগছিলো সেদিন। প্রজেক্টের কাজে এসে দেখে মোবাইল নেটওয়ার্ক ঠিকমতো কাজ করছে না। অনেকটা বেলা গড়িয়ে গেছে, পশ্চিমের গোটা আকাশ জুড়ে হালকা হলদেটে একটা আভা ছড়িয়ে পরেছে। ঘড়িটার দিকে একবার তাকালো, ঘণ্টার কাঁটা ৩-এর উপর চেপে বসে আছে। জায়গাটা শহর থেকে বেশ দূরে, এখন ষ্টেশন গিয়ে পৌঁছতে প্রায় বিকেল হয়ে যাবে। ততোক্ষণে দিনের শেষ প্যাসেঞ্জার ট্রেন কালো ধোঁওয়া উড়িয়ে বেড়িয়ে যাবে ষ্টেশন ছেড়ে, তারপর আবার রাতে ট্রেন। মাঝে কিছু লোকাল ট্রেন আছে ঠিকই, তবে সেগুলো আসানসোলের পর আর যায়না, তারপর সেখান থেকে আবার ট্রেন পালটে কলকাতা ফিরতে অনেকটাই রাত গড়িয়ে যাবে। এদিকে মোবাইলে নেটওয়ার্ক না থাকায় বাড়িতে একটা ফোন করে জানাতেও পারছে না সে, বাড়িতে বলে এসেছে সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে পড়বে। কিছু উপায় না থাকায় রাহুল বুঝে গেলো যে আজ রাতটা এখানেই তাকে কাটিয়ে দিতে হবে। পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই অঞ্চলের বয়স বাড়েনি হয়তো, তাই শহুরে আধুনিকতার থেকে এই অঞ্চল অনেকটাই পিছিয়ে, ইলেক্ট্রিসিটি এখানে পৌঁছায়নি এখনও। পেশায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়র রাহুল, সেই প্রজেক্টের কাজেই এখানে এসেছিলো সৌর বিদ্যুৎ কাজে লাগিয়ে এই অঞ্চলের ডেভেলপমেন্ট করার বিষয়ে। এখানে ইলেক্ট্রিসিটি নেই আগে থেকেই জানতো সে, তাই ব্যাগে কিছু ছোটোখাটো সৌরকোষ এনেছিল মোবাইলে চার্জ দেওয়ার জন্যে, সেগুলো তাড়াতাড়ি বের করে ফেললো। রোদ থাকতে নিজের সেলফোন আর টর্চটা এক ঘণ্টা চার্জ করে নিলো। পকেটে বেশী টাকা পয়সা নেই, আসার সময় ষ্টেশনের এটিএম-টায় টাকা ছিল না তাই তুলতে পারেনি। জায়গাটা পাহাড়ের একদম গায়েই, একটা ছোট নদী বয়ে যাচ্ছে কোনও পাহাড়ি ঝর্না থেকে বেড়িয়ে এসে। তার পাশে বসেই রাহুল ব্যাগ থেকে বিস্কুট, কেক ইত্যাদি বের করে খেতে শুরু করলো। বিকেল হয়ে গেছে, দূরের একটা মাঠে রাখাল ছেলেরা ভেড়ার পাল নিয়ে ধুলো উড়িয়ে ঘরে ফিরছে, ধুলোর মধ্যে সূর্যের লাল আভা পরে এক অপরুপ সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে। কলকাতার বিকেলে রাহুল আগে কখনও এমন সৌন্দর্য লক্ষ করেনি, সেখানে তো বিকেল মানেই শরীরে ক্লান্তি বয়ে নিয়ে ঘরে ফেরার তাড়া। সন্ধে নামবে আর কিছু পরেই, তাই বেশীক্ষণ বসে না থেকে রাহুল সেখান থেকে উঠে এবার হাঁটা শুরু করলো পাহাড়টার দিকে যদি কোনও আস্তানা পাওয়া যায়। এখানে তো অনেকেই ক্যাম্প করতে আসে, কোনও টীমকে পাওয়া গেলে বেশ ভালোই হয়। রাতটা তাদের সঙ্গে কাটিয়ে দেওয়া যাবে না হয়। তবে রাহুলের সে আশায় জল ঢেলে একটু এগোতেই পাহাড়ের একদম কোলে একটা ছোট্ট কুঁড়ে ঘরের দেখা মিলল। একেবারে ভাঙাচোরা একটা ঘর, দেখে যা মনে হল, কেউই থাকে না সেখানে। মানবসভ্যতার নিদর্শন হয়ে টিকে আছে কোনোক্রমে। চারিদিকে মাকড়শার জাল বুনে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। শহরের ছেলে রাহুল এতো বছরের জীবনে কখনও এরকম পরিবেশে থাকেনি, কিন্তু আজকের রাতটা যা হোক করে এখানে মানিয়ে নিতেই হবে। কারণ সন্ধে নেমে আসছে, সে আর এগোতে সাহস পাচ্ছে না, জঙ্গলে হাতি, শেয়াল, হায়না তো আছেই। তাড়াতাড়ি করে আশপাশ থেকে কাঠ-পাতা কুড়িয়ে আগুন করে ফেললো, সাঁঝের আকাশের ধোঁয়া উড়তে লাগলো। একটু আগুন, ধোঁওয়া থাকলে রাতের দিকে পশু-প্রাণীরা এদিকে আসবে না, ধোঁওয়ার জন্য মশা-মাছিদেরও উৎপাত থেকেও রেহাই পাওয়া যাবে। রাতে ঘুমনো যাবে না, এখানেই জেগে কাটাতে হবে, কারণ কুঁড়ে ঘরের ভিতর যা অবস্থা সেখানে পিঠ পেতে ঘুমোতে গেলে জামাকাপড়ের মায়া ত্যাগ করতে হবে। মোবাইলে টাওয়ার না থাকায় চার্জ বেশ তাড়াতাড়ি কমছে, তাই মোবাইলটা ফ্লাইট করে দেওয়াই ভালো। ইতিমধ্যে রাহুল মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল নেটওয়ার্ক-এর পাশে একটা কাঁটা এসেছে। তাড়াতাড়ি করে বাড়িতে ফোন করলো কিন্তু এতটাই বেহাল দশা যে, অর্ধেক কথা শোনাই যাচ্ছে না। সময় নষ্ট না করে বাড়িতে একটা এসএমএস পাঠিয়ে দিলো, ২-৩ বার চেষ্টা করে এসএমএস টা সেন্ড হল, কিছুক্ষণ পর বাড়ি থেকে এসএমএস-এর রিপ্লাই পেয়ে একটা চিন্তা মাথা থেকে দূর হল। ফোনটা ফ্লাইট করে রেখে দিলো ব্যাগে। এখন বসন্তের আগমন ঘটেছে বাতাসে, পাহাড়ি অঞ্চল রাত গড়াতেই হালকা শীত লাগছে গায়ে। আগুনের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে তাপ নিলো শরীরে। চারদিক নিস্তব্ধ, ঝিঁঝিঁপোকার আওয়াজে ভরে উঠেছে চারদিক, মাঝে মাঝে হাওয়া দিলে পাতার খসখস শব্দ। দূরের জঙ্গলে বন্য প্রাণীদের ডাকও শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। কিছুক্ষণ পর ঝিঁঝিঁপোকার শব্দটা থেমে গেলো। মুখটা তুলে দূরে পাহাড়টার দিকে তাকাতে গিয়ে আকাশের দিকে চোখ গেলো। একই পরিবেশের সকাল আর রাত্রির দুটো দৃশ্যকে একসাথে যেন মেলাতেই পারছে না সে। মাথার উপর আকাশটা তারায় ভরে উঠেছে, পাহাড়টা চাঁদের আলোয় বেশ সেজে উঠেছে, দূরের ঝোপটায় সাদা রঙের বনফুল গুলো চাঁদের আলোয় মাথা তুলে দোল খাচ্ছে আর তার সঙ্গে কানে ভেসে আসছে অনেক দূরের কোনও এক গ্রাম থেকে আদিবাসী মানুষদের গানের সুর। রোমাঞ্চে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো রাহুলের। শহরে রাত্রি নামলেই বড়ো বড়ো বিজলী বাতিগুলো উজ্জ্বল হলুদ চোখে তাকিয়ে থাকে পথের দিকে, তাদের আলো ভেদ করে আকাশের অন্ধকারে দৃষ্টি পৌঁছয় না সহজে, তাই এর আগে কখনও এমন সৌন্দর্য উপভোগ করেনি রাহুল। আধুনিক মানব সভ্যতা থেকে পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চল যে তাকে এভাবে একপ্রকার মুগ্ধতা দেবে সেটা তার কাছে কল্পনাতীতই বটে। দূরে কোনও এক বন থেকে বসন্তের হাওয়া শরীরে করে মহুয়ার গন্ধ বয়ে আনছে মাঝে মাঝে, এরকম রোমাঞ্চের মাঝে একা বসে থেকে সেই গন্ধে একপ্রকার নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে রাহুল। এভাবেই লাল মাটির পরিবেশে প্রকৃতির স্নেহে মাথা রেখে কখন যে তার দু-চোখে ঘুম নেমে এসেছে কিছু বুঝতেই পারলো না, যখন ঘুম ভাঙল উঠে দেখল আকাশের আঙিনায় আলো ফুটে গেছে অনেক আগেই। দূরের পাহাড়টার কোল বেয়ে সোনালী রোদ ঝড়ে পরেছে আশেপাশের ছোট ছোট জঙ্গলগুলোর উপরে। আগুনটাও নিভে গেছে, শুধু পরে আছে কিছু ছাই আর আধপোড়া কাঠ। হাতঘড়িতে চোখ যেতেই দেখল ৮-টা বাজে, তাড়াতাড়ি করে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো। ট্রেকার ধরে সময়ে ষ্টেশনে পৌঁছতে পারলে একটু পরেই একটা ট্রেন আছে, আগের দিনের রিটার্ন টিকিট-টা পকেটে হাত দিয়ে একবার দেখে নিলো আছে কিনা। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে হাতে পায়ে ধুলো ঝেড়ে নিয়ে ট্রেকার ধরার জন্যে দূরের বড়ো রাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করলো পায়ের ছাপগুলোকে পিছনে ফেলে। ষ্টেশনে পৌঁছে সময়েই ট্রেনটা পেয়ে গেলো। বিকেলে কলকাতা পৌঁছে বাড়ি ফেরার সময় পথের ধারে কোথা থেকে একটা গানের আওয়াজ ভেসে আসছে, “এই শহর থেকে আরও অনেক দূরে, চলো কোথাও চলে যাই...”, রাহুল নিজের পায়ের দিকে একবার তাকালো, তখনও ওর জুতোর গায়ে আঁকড়ে ধরে আছে লালমাটির জীবাশ্ম। ক্ষণিক থমকে থেকে আবার আনমনে ফুটপাথ ধরে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলো কলকাতার ক্লান্ত বিকেলে, সঙ্গে মনের ভিতর সঞ্চয় করে রাখল গত রাতের অভিজ্ঞতাগুলোকে।
No comments:
Post a Comment