Friday, March 30, 2018

আগুনের পরশমণি

সন্ধ্যা নেমে গেছে, লেকের ধারে গিয়ে অনেকটা সময় আমরা চারজন একসাথে কাটালাম। ওদিকে তাঁবু খাটানোই আছে, পাহারা দেওয়ার কেউ নেই অতএব তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। যদিও হোটেল মালিক বলেছেন অসুবিধা নেই, তবুও আমাদের মন সায় দেয় না, তাড়াতাড়ি ফিরে আসি। ইচ্ছে আছে সারারাত না হলেও মাঝরাত পর্যন্ত আগুন করে আড্ডা দেবো একসাথে। তারপর দু'জন তাঁবুতে থেকে যাবে আর বাকি দু'জন হোটেল রুমে ফিরে যাবে। কিন্তু আগুন যে করবো, কাঠ কই? আশপাশ ঘুরে জানলাম কেউ এখানে কাঠ বিক্রি করেন না, তারা সমস্ত কাঠ বাজারে বিক্রি করেন। যাই হোক, কি আর করা যাবে, না হয় গাছের পাতা জ্বালিয়েই আগুন জ্বালতে হবে, কিন্তু এতে আর কতক্ষণ আগুন জ্বলবে গ্যারান্টি নেই। কারণ শুকনো পাতা নিমেশে ছাই হয়ে যায়, ধোঁয়া হয়ে আগুনের চোখ রাঙানি লাল হয় কিন্তু তেজ বাড়ে না। তবুও শেষবার চেষ্টা করে দেখা যাক কাঠ পাওয়া যায় কিনা, ওই তো অন্ধকারে মোড়ের মাথায় দু'জন স্থানীয় ভদ্রমহিলা গল্প করছেন, ওদের কাছে গিয়ে...

- দিদি, এখানে কাঠ কোথায় পাওয়া যাবে একটু বলতে পারেন?
- (প্রত্যাশিত ভাবেই উনি প্রশ্ন ছুঁড়লেন আঞ্চলিক ভাষায়, পূর্ণ বাক্য না বুঝলেও যেটুকু বুঝলাম এটাই দাঁড়ায়) কাঠ কিই কইরবে এই রাইত্রে? এইখনে তো পাইবে না, ওইদিক যাও, আদিবাসীরা হইতো দিতে পারে।
- কিছু কাঠ পাওয়া গেলে খুব ভালো হতো, একটু আগুন জ্বালাতাম।
- আগুন জ্বেলে চিইকেইন কইরবে নাকি?
[প্রসঙ্গত বলে রাখি, ওখানে 'মুরগি'র বদলে 'চিকেন' শব্দটি বেশী ব্যবহৃত হয়ে থাকে, হয়তো পর্যটন শিল্পের কাঁচা দাগ]
- আসলে আমরা ওখানে তাঁবু করেছি রাতে থাকবো, তাই একটু আগুন জ্বেলে বসবো, রান্নাবান্না করবো না।
- (অপর ভদ্রমহিলাটি ইনাকে বিদায় জানিয়ে রাস্তা ধরে অন্য দিকে হেঁটে চলে গেলেন) আইসো তাইলে আমার সাথ...

আমি গেলাম উনার পিছুপিছু। গ্রামের একদম শুরুতেই বাঁদিকের একটি মাটির বাড়িতে উনি নিয়ে গেলেন। বিজলী এখনও প্রবেশ করেনি, অন্ধকার উঠোনে লম্ফ জ্বালিয়ে খাটিয়ার উপর একজন তুলনামূলক বয়স্ক মহিলা শুয়ে ছিলেন। আমাকে নিয়ে গিয়ে ওই ভদ্রমহিলা তেনার কাছে আঞ্চলিক ভাষায় কিছু একটা বললেন এবং আমাকে ওখানে দাঁড়াতে বলে উনারা দুজনেই ভিতরে চলে গেলেন। যা বুঝলাম আমার কিছু কাঠ লাগবে এরকমই কিছু একটা বললেন। কিছুক্ষণ পড়ে উনি ফিরে এলেন সঙ্গে এক গুচ্ছ কাঠ বেঁধে নিয়ে। আমি উনার থেকে সেই কাঠের গুচ্ছ হাতে নিয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করি "এগুলোর দাম কত?", উনি কিছু একটা আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি তবে দ্বিতীয় বার বলার পর যা বুঝলাম সেটার মানে দাঁড়ায় যে "নিয়ে যাও, কিছু লাগবে না।" এতক্ষণে আমার এক বন্ধুও ওখানে এসে উপস্থিত হয়েছে, দু'জনেই মনস্থির করেছি এই কাঠের দাম দিয়ে তবেই আমরা যাবো। উনি বারবারই দাম নিতে অস্বীকার করতে থাকেন, শেষমেশ বলেন "দাউ তুমরা যা ভাইল বুঝো" এখানেও আমার আপত্তি, কখনও জঙ্গলে গিয়ে এভাবে কাঠ কুড়িয়ে সমান মাপ করে কেটে জোগাড় করিনি, অতএব তাদের পরিশ্রমের দামটা কল্পনায় হিসেব করাটা খুবই কঠিন আমার কাছে। কি জানি, একটা দাম দিয়ে দেবো সেটা হয়তো উনাদের কাছে কম মনে হতে পারে। আসলে অনেক জায়গায় দেখেছি কীভাবে আদিবাসী শ্রেণীর মানুষেরা জঙ্গলের কাঠ কুড়িয়ে সেগুলোকে একসাথে বেঁধে মাথায় নিয়ে খালি পায়ে চড়াই উতরাই পথ পেড়িয়ে পাহাড়ের মাথা থেকে নীচে নেমে আসেন শুধুমাত্র একটা লাঠির উপর ভর করে, যে পথে আমরা ভালো স্পোর্টস-সু পড়েও হোঁচট খাই। তাই আমরা সাফ সাফ-ই উনাকে জানিয়ে দিলাম, "আমাদের তো অভিজ্ঞতা নেই এই কাঠের দাম সম্পর্কে, আপনি একটা দাম বলুন, আমি সেটাই দেবো..."। তবুও উনি বেশ কয়েকবার আপত্তি করার পর একবার শেষে ক্লান্ত হয়ে বলেই দিলেন "দিয়ে যাও বিশ-ত্রিশ টাকা..."। মানিব্যাগ বের করে ত্রিশ টাকা উনার হাতে দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম। বেড়িয়ে এসে ফিনফিনে একটা ল্যাম্পপোস্টের তলায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ভাবলাম, এতগুলো টাকা উনি নিতে অস্বীকার করছিলেন! হ্যাঁ এতোগুলো টাকা! ত্রিশ টাকার অঙ্কটা আমাদের কাছে খুব কম মনে হতে পারে, কিন্তু ওই মানুষগুলোর কাছে একটা দশ টাকার নোটও ভীষণ দামী। এই মানুষগুলির ত্রিশ টাকায় একটা গোটা দিনের পেট চলে যায় এবং তাদের রোজগারও খুব যৎসামান্য, কারণ এই পাথুরে জমিতে চাষবাস করাটা একটু কঠিন, আর উৎপন্ন শস্যের বেশীরভাগটাই দিতে হয় জমি মালিকদের। এখানে আশেপাশের হোটেলগুলিতে আবার খাবার দ্রব্যের দাম ভীষণ বেশী, এক থালা ভাত, ডাল এবং কিছুটা আলু পোস্তর তরকারী খেতে হয়েছে একশো টাকা দিয়ে, সাথে অবশ্য এক্সট্রা কুড়ি টাকায় এক বাটি ভর্তি সুস্বাদু চিকেন পাওয়া গেছে। সন্ধ্যায় একটি নর্মাল সাইজের থালার প্রায় অর্ধেকেরও কম মুড়ি হোটেল থেকে কিনে খেতে হয়েছে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে, যার দাম আসলে দশ টাকাও হবে কিনা সন্দেহ। তবে এগুলো কোনওটাই এখানকার আসল দাম নয়, ব্যবসার খাতিরে হয়তো কিছুটা বাড়ানো আছে। কারণ শেষবার যখন গিয়েছিলাম ওই একই জায়গায় একটু অন্যদিকে, তখন ওই একই খাবার পঁয়ত্রিশ টাকায় খেয়েছিলাম একটা ছোট খাবারের দোকান থেকে। খাবারের এই দামের পিছনে প্রধান কারণ ওই জায়গায় আশেপাশে আর কোনও খাবারের দোকান নেই, তাই সমস্ত হোটেল মালিকরা একটা ফিক্সড দাম ঠিক করেই রেখেছেন। সমস্ত হোটেলেই প্রায় খাবারের দামটা একই, খুব বেশী হলে মাত্র পাঁচ টাকার তফাৎ। আসল ব্যাপারটা এখান থেকেই স্পষ্ট আমাদের কাছে। একই পরিবেশে একদিকে ব্যবসায়িক লাভের ফল এবং অন্যদিকে এখানকার সাধারণ মানুষের সাহায্যের সন্তুষ্টি, এই দুই ধরনেরই মনের ছোঁয়া পেয়ে আমাদের বরুন্তি ট্যুর শেষ করে ফিরে এলাম। কিছু শুকনো কাঠের গুঁড়ি অগ্নিদেবের দূত হয়ে আমাদের চিনিয়ে দিলো প্রকৃতির ভালোবাসায় মোড়া একটি ছোট্ট গ্রামের মানুষদের আন্তরিকতা এবং অতিথি আপ্যায়নতা। বেঁচে থাক এই মানুষগুলির ভালোবাসা, সরল হাসিতে মোড়া থাক সমস্তটা গ্রাম। আবারও এই দেওয়াল জুড়ে লিখতে বসবো যদি নতুনভাবে কখনও কোথাও এরকমই কিছু মানুষের ভালোবাসা পেয়ে থাকি।

No comments:

Post a Comment