Thursday, October 26, 2017

উৎসবের আলো

চোখ ধাঁধানো আলোর ভিড়ে
সাজছে আমার শহর,
উৎসবের এক মিলনমেলা
জীবন্ত একটা নগর।

Wednesday, October 25, 2017

আমার সংজ্ঞা

ঝড়ের হাওয়া আছড়ে পড়ে
নৌকো ভরা স্বপ্ন ভিড়ে,
আমার হৃদয় দু-আধখানা
খঞ্জনার ওই ছিন্ন নীড়ে।
দৃশ্য ছাড়া ভিজবো কীভাবে
বদ্ধ ঘরের প্রেক্ষাগৃহে?
আমার সংজ্ঞা আমিই লিখি
মাথার ভিতর শব্দ দিয়ে।

Tuesday, October 24, 2017

অন্ধ পথিক

ফুটপাতে এক ধর্ষিত মেয়ে
হাত বাড়িয়ে সাহায্য চায়,
পথের মানুষ ব্যস্ত ভীষণ
ক্যামেরা খুলে ভিডিও বানায়।
চোখ ফেরানো মানুষগুলো
হাত গুটিয়ে শান্ত সাজে,
এতোই শান্ত, ওদের দেখি
যেখানে ধর্মযুদ্ধ বাঁধে।

Monday, October 23, 2017

প্রথম চুম্বন

আমার প্রথম চুম্বন লুকিয়ে এই শহরে,
বৃদ্ধ বটের নীচে অথবা হারানো সময়ে।

Saturday, October 21, 2017

শুভ ভাতৃদ্বিতীয়া

কপাল ছুঁয়ে স্নেহের ফোঁটা
ভাইয়ের আয়ু বাড়ে,
বোনের চলার পথটুকুও
উঠুক আলোয় ভরে।

Wednesday, October 18, 2017

বারুদের চিৎকার

শহরের গায়ে আলোর গয়না,
উৎসবে মাতুক রাত,
এ শহরে কেউ এগিয়ে যায়না,
পিছিয়ে পড়ার ধাত।
তবু আমি তুমি বসে অভিমান করি
অতীতের কারাগারে,
আমাদের কথা ঢাকা পড়ে যায়
বারুদের চিৎকারে।

Tuesday, October 17, 2017

আটপৌরে

আমি আটপৌরে এক লেখক,
কবিতায় ছন্দ নেই, শুধুই শব্দ,
কিছুটা একঘেয়ে, কিছুটা দগ্ধ,
চিন্তাশক্তির উঠোনে কবিতারা
শহরের মৃত কারখানার মতো
প্রতিদিন শুয়ে কাঁদে, শুরুর কোনও গল্প নেই,
এখানেই কবিতার জন্ম, ব্যথার মুক্তি এখানেই।

Monday, October 16, 2017

ভাঙা বিকেলের রোদ্দুর

আমিও জেগে উঠি প্রতিদিন একা ঘুমন্ত অন্ধ রাতের প্রান্তরে,
ব্যথা জমে কিছুটা মনকেমনে অথবা মৃত অতীতের হাত ধরে,
যদি ভেসে আসে তরী কোনও ফাঁকা বন্দরের পথে চোখ চেয়ে,
তোমাকে ছুঁয়ে দেখতে চাইবো আবার ভাঙা বিকেলের রোদ্দুরে।

Sunday, October 15, 2017

শামুক মৃত্যু

শ্লথ শরীরের বেঁচে থাকার দ্বিধায়
ব্যস্ত শহরের পথে চাকার গতি বাড়ছে,
দুই চোখ ভরা স্বপ্নের চির বিদায়,
রাস্তার বুকে মৃত শামুকের শেষ ইচ্ছে।

Saturday, October 14, 2017

অসমাপ্ত

তুমি তো ভালোবাসতে পারো জোৎস্নার আলো ভেদ করে,
তুমি তো পাশে হাঁটতে পারো মোহনায় আমার হাত ধরে।
চোখে ঠোঁট রেখে কথা দিতে পারো অন্ধ চোখে রাত বাকি,
জোনাকির আলো একা ঘরে ফেরে অশ্রু মোছে রাতপাখি।

Thursday, October 12, 2017

অবাধ্য জ্বর

আমি ফিরে যাবো তোমার ঠিকানায়
শীতের সোনা ঝরা দুপুরের রোদ্দুরে,
জানি তোমাদের ভালোবাসা বিছানায়
বেড়ে ওঠে রাতের উষ্ণতার হাত ধরে।
ঝড়ের ক্লান্তি মেখে গায়ে আমি উড়বো
ভেজা তুলোর শরীরে ওজনের ভর করে,
মাঝরাতে তোমার ধমনীতে আমি ফিরবো
বেড়ে যাওয়া রক্তচাপের অবাধ্য জ্বর হয়ে।

Monday, October 9, 2017

জলজ প্রান

চিত্রঃ- ঝরনার জলপান
জঙ্গলের শরীরে স্নিগ্ধতা বয়ে নিয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী, ঝরনা হয়ে পাথরের গা বেয়ে নেমে গেছে সমতলের দিকে। আর এই নদীর বুকেই আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে কিছু জলজ জীব। কাঁকড়া, চিংড়ি, শোল মাছ, আরও রকমারী সব মাছ এবং পোকা। এই জঙ্গলেই একদিন ঝরনার পাশে চিংড়ি এবং কাঁকড়া শিকার করতে বেড়িয়েছিলাম গাড়ির চালক এবং এক সঙ্গীকে নিয়ে। ভেবেছিলাম ঝরনার ধারেই এগুলো পেঁয়াজ, লঙ্কা আর মশলা দিয়ে ঝাল করে রেঁধে লেবুর রস দিয়ে হালকা করে মাখিয়ে খাওয়া যাবে। উপর দিয়ে খুব আলতো স্রোতে জল বয়ে যাচ্ছে আর একটু খাঁজ মতো দেখে একটা পাথর খুঁজে বের করা হলো, তারপর তার উপর গামছা ডুবিয়ে বিছিয়ে দেওয়া হল। পাশেই ভাত আর দেশী মুরগী রান্না করছে আমাদের অন্য সঙ্গীরা, কয়েকটা ভাত নিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হল গামছার উপর। এবার ওই ভাত খেতে চিংড়িগুলো একে একে যেই এসে জমবে ওমনি সুযোগ বুঝে গামছার চারটি কোন আসতে আসতে তুলে নিলেই কেল্লা ফতে, চিংড়ি আমার হাতে। চিংড়ি কয়েকটা ধরলাম, কিন্তু সে দেখতে আজব। হলদেতে কালো রঙ আর গায়ে বাঘের মতো ডোরাকাটা দাগ। কি থেকে কি হয় কেউ জানে না, এই চিংড়ি খেয়ে অসুস্থ হলে তখন কে সামলাবে! তাই চিংড়ি ছেড়ে কাঁকড়া ধরা শুরু হল, নদীর কাঁকড়া দারুন সুস্বাদু, গাড়ির চালক এই বিষয়ে বেশ অভ্যস্ত, সে পাথর দেখেই বলে দিচ্ছে কোন পাথরের নীচে কাঁকড়া লুকিয়ে রয়েছে আর হাত ধুকিয়েই ধরে দিচ্ছে। এভাবে অনেকগুলো কাঁকড়া শিকার হলো। একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে সেগুলিকে বন্দী করে রাখা হল। মাংস রান্না হলে তারপর রাঁধা হবে, কিন্তু প্রকৃতি সায় দিল না। আগেই বলেছিলাম সেদিন অর্ধেক রান্নার পর ঝেঁপে বৃষ্টি আর সঙ্গে বজ্রপাত, তাই অগত্যা সময় নষ্ট না করে ওগুলোকে জলে ছেড়ে দিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম কারণ বৃষ্টি জোড়ে এসে গেলে রাস্তায় ধস নেমে বেরনো মুশকিল হয়ে যাবে। এই জলেই বাস করে রকমারী সব পোকা। জুতো আর মোজা ছেড়ে রেখে ঝরনার জলে একদিন স্নান করেছি, স্নান করে কিছু বুঝিনি, পোশাক পরিবর্তন করে জুতো মোজা পড়ে বাকি স্পটগুলি ঘুরে ফিরে এসেছি হোটেলে। পায়ের আঙুলে একটা অস্বস্তি সকালে স্নান করার পর থেকেই হচ্ছিল তবে গুরুত্ব দিইনি অতটা। সন্ধ্যাবেলা হোটেলরুমে আড্ডার ফাঁকে হঠাৎ পায়ের আঙুলের দিকে চোখ যেতেই দেখি একটা ছোট্ট পোকা, দেখতে অনেকটা মটর কড়াইয়ে যে পোকা থাকে সেরকম, কামড়ে বসে আছে দুটো আঙুলের মাঝে। ভাবলাম এ আর এমন কি, তাড়াতাড়ি করে টেনে সরাতে গিয়ে পায়ের আঙুল দুটোয় বেশ ব্যথা পেলাম, আমার ভুল ভাঙলো। পোকাটা ছয়টা পা আর মুখে স্প্রিং-এর মতো হুলটা আমার শরীরে ঢুকিয়ে আঁকড়ে বসেছিল, আস্তে আস্তে ভিতরেই চলে যেত যদি না চোখে পড়তো। তাকে তো টেনে বেড় করলাম তবে তক্ষুনি কিছু বুঝিনি। একটা রাত কাটানোর পর ধীরে ধীরে ওই দুটি আঙুলের হাড়ে প্রচন্ড ব্যথা। পোকাটা ওভাবে আঁকড়ে বসে হাড়ে হুল ফুটিয়ে হাড়ের রস খেয়েছে। এই প্রকৃতি বেশ রহস্যময়, এখানে কতরকমের জীবের বাস। একটু অসাবধানতায়, বড়ো রকমের ক্ষতি হতে পারে। টিকে থাকতে হলে জঙ্গলের নিয়মই হল তাই, মরো নয়তো মারো, সেটা এই ছোট্ট পোকাটাও শিখে ফেলেছে প্রকৃতির জাদুবলে।

Sunday, October 8, 2017

মহুয়া বনের অন্তরে

চিত্রঃ- কিরিবুরু জঙ্গল
ঝাড়খণ্ডের কিরিবুরু, পাহাড়ের মাথায় ছোট্ট একটা শহর বলা যেতে পারে। সেখানকার আবহাওয়া, পরিবেশ সবই আমাকে মুগ্ধ করেছে। এই শহরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এখানে জল, বিদ্যুৎ, যাতায়াত সবই ফ্রী। শহর থেকে অদূরেই সারান্ডা ফরেস্ট, এই জঙ্গলে সাধারণভাবে ঢোকার অনুমতি নেই। তার জন্য নিজের পরিচয়পত্র জমা করে বিশেষ আপিল করে তবেই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিসারদের থেকে অনুমতি পাওয়া যায়। সারান্ডা ফরেস্টের ভিতরই রয়েছে Steel Authority of India Ltd. (SAIL)-এর নিজস্ব কারখানা আর তাদের নিজস্ব যাতায়াতের গাড়ি, যেগুলো এখানকার সাধারণ মানুষকে বিনামূল্যেই তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। এই কোম্পানি নিজেরা বিদ্যুতও উৎপাদন করে থাকে, নিজেদের প্রয়োজনমত বিদ্যুৎ নিয়ে বাকি অতিরিক্ত বিদ্যুৎ এখানের লোকালয়ে, বিশেষ করে সরকারি অফিসগুলিতে বিনামূল্যেই বণ্টন করে দেয়। এই শহর আসলে লোহার শহর, রাস্তাঘাট যেদিকেই চোখ যায় সব জায়গাতেই কাঁচা লোহা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। শোনা যায় আজ থেকে বেশ কয়েক দশক আগে এখানকার মানুষ সেই লোহা কুড়িয়ে বিক্রি করেই বেশ মোটা অঙ্কের টাকা উপার্জন করে ফেলেছে, তবে এখন সে'সব বন্ধ হয়েছে সরকারের হস্তক্ষেপে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে লৌহখনি, আর বিছানো রয়েছে রেলপথ, খনি থেকে লোহা তুলেই সরাসরি সেগুলো উপযুক্ত স্থানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এই ব্যবস্থা। জঙ্গলের ভিতর অধিকাংশ এলাকা জুড়েই পলাশ, পাইন, শাল ও মহুয়ার ঘন বন। এই ঘন জঙ্গলে সূর্যের আলো ঠিকঠাক মাটি পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না, তাই বেঁচে থাকার সংগ্রামে প্রতিটা গাছই ভীষণ লম্বা, তাদের মধ্যে প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধ চলে সূর্যের আলো শিকারের। রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর সিংহ বাদে প্রায় সব রকমেরই হিংস্র জীবজন্তু রয়েছে এই জঙ্গলে। মহুয়ার বন বেশী থাকায় ভাল্লুকের সংখ্যা একটু বেশীই, কারণ ভাল্লুক মহুয়ার রস খেতে ভালবাসে। এই লোহার শহরে মাটির বড়োই অভাব, চারিদিকে লোহা মিশ্রিত কাঁকুড়ে লালমাটি। তবে সেই অভাব দূর করতে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। ভাবছেন মাটি নিয়ে কি হবে? সেকি, মাটি ছাড়া চাষবাস হবে কিকরে! তাই এখানকার চাষ-আবাদ পদ্ধতিও বেশ অদ্ভুত (ঝুম চাষ পদ্ধতি), জঙ্গলের কিছুটা অংশ আগে বেছে নেওয়া হয় চাষ-আবাদের জন্য তারপর সেখনাকার গাছগুলোর গোরার কাছে কিছুটা অংশ ফুটো করে ফাঁপা করে দেওয়া হয় এবং সেগুলোকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে দেওয়া হয়। গাছগুলি মরে গিয়ে শুকিয়ে গেলে সেগুলিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় এবং তারপর সেগুলো পুড়ে ছাই হয়ে কাঁকুড়ে মাটির উপর পুরু একটা আস্তরণ ফেলে জমা হয়, আর তার উপরেই হয় চাষ-আবাদ। আর যেখানে চাষ-আবাদ হয় তার আশেপাশেই বিশাল বিশাল গাছের উপর ঘর বানিয়ে মশারি খাটিয়ে বাস করেন কিছু মানুষ, পোকামাকড়ের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য মশারি আবশ্যক। এই মানুষগুলি ফলনের সময় রাত জেগে পাহারা দেন যাতে হাতি এসে ফসল নষ্ট না করে। জঙ্গলের ভিতর গাড়ি নিয়ে বেড়াতে গেলে চোখে পড়বে কাঁচা রাস্তার আশেপাশে এখানকার মানুষদের গ্রাম, পর্যটকদের দেখে হাসিমুখে "টাটা" দেয় কিছু বাচ্ছা আদিবাসী সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা অর্থাৎ তারা শুভ যাত্রা কামনা করে, আর তারপর গাড়ির পিছনে ওরা ছুটে আসে। সঙ্গে যদি ভালোমন্দ কিছু খাবার থাকে ওদের হাতে তুলে দিলে অথবা ওদের হাতে কিছু টাকা পয়সা দিলে ওদের মুখে যে সরল হাসিটা দেখা যায় তার থেকে পরম আনন্দের কিছু হয়না। এই জঙ্গলের ভিতর অভাবের সঙ্গে লড়াই করেই ওরা প্রতি মুহূর্তে বড়ো হচ্ছে এবং চাষ-আবাদ করে ওদের বাবা-মায়েরা অন্ন তুলে দিচ্ছেন সেখানকার সাধারণ মানুষের মুখে। আসলে ওদের জনজীবন জঙ্গলের অদৃশ্য কাঁটাতারেই বন্দী, জঙ্গলের পথ পেড়িয়ে শহরে যাওয়া বেশ কঠিন, তারা লোকালয়ে একসাথে হয়ে বিভিন্ন উৎসবও পালন করে থাকেন। পর্যটকরা জঙ্গলে বিপদে পড়লে তারা নিমেশে ঝাঁপিয়ে পড়েন সাহায্যের জন্যে। তাদের মধ্যে জাত-ধর্মের কোনও ভেদাভেদ নেই, তারা একটাই কথা জানে, তারা প্রত্যেকে মানুষ, আর জঙ্গলের ভিতর প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে চাষ-আবাদ করে সাধারণ মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিয়ে সেই মানবিকতার চূড়ান্ত প্রমান দিয়ে চলেছেন প্রতি মুহূর্তে। ইচ্ছে রইলো এই জঙ্গলে আবার ফিরবো, সঙ্গে কুড়িয়ে নিয়ে আসবো আরও অনেক রোমাঞ্চ।

ভাল্লুকের সন্ধানে


চিত্রঃ- মাঝখানে অন্ধকারের কুণ্ডলী পাকানো ভাল্লুকের গুহা
বাইরে বেড়াতে গেলে নিজেরা রান্না করে খাওয়ার একটা আলাদা মজা আছে। এবারেও জঙ্গলে গিয়ে নিজেরা রান্না চাপালাম, ভাত আর বাজার থেকে কিনে আনা দেশী মুরগীর মাংস। জঙ্গলে জলের খুব সমস্যা তাই সেই অসুবিধা দূর করতে ঝর্নার কাছেই রান্না করা হল। জল বেশ স্বচ্ছ এবং গাড়ির চালক জানালো এটা পানের যোগ্য। একদম ঘন জঙ্গল, জনবসতি বেশ দূরে এখান থেকে, ভীষন সাংঘাতিক যায়গা, বন্য জন্তু জানোয়ারের বাস এখানে। তবে জন্তু জানোয়াররা অবশ্য এখানকার মানুষকে ভয় পায়, কারণ এখানকার মানুষও বেশ অভ্যস্ত এই জনজীবনে, তারা নিমেষে কাবু করতে পারে বন্য জীবজন্তুকে। এদিকে আমাদের রান্না হচ্ছে, ভাত প্রায় হয়ে এসেছে, জায়গাটা যে সাংঘাতিক তার প্রমান পেলাম আশেপাশেই কোথাও একটা ভাল্লুকের গর্জন শুনে। চালক জানালো ভাল্লুক মাংসের গন্ধ পেয়েছে তাই গর্জন করছে, আশেপাশেই আছে যেকোনো মুহুর্তে এখানে চলে আসতে পারে। তবে আমরা সাহস করে সেখানেই রয়ে গেলাম, রান্না শেষে খাওয়াদাওয়া সেরে ভাল্লুকের গুহা দেখতে যাবো। কিন্তু প্রকৃতি আমাদের সাথ দিলো না, হঠাৎই ঝেঁপে বৃষ্টি আর সঙ্গে আকাশের বুক চিঁরে নেমে আসছে বিদ্যুতের ঝলকানি আর মেঘের গর্জন। নিঃস্তব্ধ জঙ্গলের ভিতর মেঘের গর্জনটা আরও ভয়ঙ্কর লাগছে। তাড়াতাড়ি সমস্তকিছু গুছিয়ে কোনও মতে গাড়িতে উঠলাম, যে করেই হোক এখান থেকে বেড়োতে হবে। এক জায়গায় রাস্তার উপর দিয়ে ঝর্নার জল বয়ে গেছে, বৃষ্টিতে এই রাস্তায় ধস্ নামতে পারে যেকোনো মুহুর্তে। তবে ভাগ্য ভালো জায়গাটা উতরে গেলাম, কাছেই একটা সরকারী বিশ্রামাগারে গিয়ে উঠলাম, একদম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ডেকরেশনে ফাইভ স্টার হোটেলকেও হার মানাবে, জঙ্গলের একদম কোলেই। তবে আমাদের কাছে স্পেশাল পারমিশন থাকার কারণে সেখানে ঢুকতে কোনও অসুবিধা হল না। ওখানে গিয়ে ভিতরেই বাকি রান্নাটুকু সেরে ফেলা হল, ওখানকার রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বে যিনি আছেন পাশেই মিলিটারি ক্যাম্প থেকে প্রয়োজনীয় পানিও জলের ব্যবস্থা করলেন। রান্না শেষে আমরা সবাইমিলে একসাথেই খেতে বসলাম টেবিলে। খেয়ে উঠতে উঠতে বেলা গড়িয়ে গেলো, ঘড়ির কাঁটা বলছে সাড়ে চারটে। ওখানকার রক্ষীকে কিছু বকসিস্ দিয়ে বেড়োলাম, এবার যাবো ভাল্লুকের গুহায়। যাওয়ার পথে মিলিটারি চেকপোস্টে কর্তব্যরত অফিসাররা জানান সামনে কিছুটা এগিয়েই বিশাল এক গাছ রাস্তার উপর পড়ে আছে, গাড়ি যাবে না হয়তো, তবে উনারা আমাদের বাধা দেননি, কেবল সাবধান করলেন। কিছুটা পথ এগিয়ে দেখলাম সত্যিই তাই, প্রকান্ড এক গাছ উপরে পড়ে আছে রাস্তার উপর। গাড়ির চালক জানালো বাকি দেড় কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটেই যেতে হবে। সন্ধ্যা নামার মুখে ওখানে না যাওয়াই ভালো, তার উপর ঘন জঙ্গলে অন্ধকারটা আরও ঘনিয়ে উঠেছে, প্রচুর ভাল্লুক আছে এই অঞ্চলে, সঙ্গে চিতাও আছে। যেকোনো মুহুর্তে অ্যাটাক করতে পারে, গতমাসেই একজনকে ভাল্লুকে মেরে ফেলেছে, আর এখন ভাল্লুকদের ডেরায় ফেরার সময়, তাই ফিরে যাওয়াটাই ভালো হবে। আমরা একটু অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়, তাই ফিরে আসতে মনটা ঠিক মানলো না। আমাদের বাকি সঙ্গীদের কয়েকজন বললো ফিরে যেতে আবার কয়েকজন বললো ভাল্লুকের গুহায় যাবে। তাই শেষে ঠিক হলো আমরা চারজন সঙ্গী মিলে জঙ্গলে যাবো, সঙ্গে গাড়ির চালক যাবে আর বাকিরা গাড়িতেই অপেক্ষা করবে আমাদের। যেমন প্ল্যান তেমনই কাজ, চালক বলে দিলো বিপদ বুঝলেই দৌড়াতে, এখানে কেউ কারোর জন্য অপেক্ষা করবে না। জঙ্গলের দিকে রওনা হলাম, প্রায় এক কিলোমিটার গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়লো ভাল্লুকের থাবার টাটকা ছাপ, কিছুক্ষন আগেই এখানে ভাল্লুক এসেছে। একটু ভয় পেলাম, থ্রিলটাও বেশ কয়েকগুন বেড়ে গেলো সঙ্গে উৎসাহটাও। এবার চারদিকে নজর রেখে ধীরে ধীরে এগোচ্ছি, এমন সময় কিছুটা দূরেই ভীষন শব্দে একটা ভাল্লুকের গর্জন। যত পথ এগোচ্ছি তত ভয় আর উৎসাহ সমানুপাতে বাড়ছে মনের ভিতর। একটু এগোতেই হঠাৎ কিছুটা দূরেই একটা গাছ থেকে ঝুপ করে কিছু একটা ঝাঁপ দিলো। সবাই থমকে গেলাম, একজন বললো আর এগোনো ঠিক হবে না। কিন্তু আমরা এখন এমন জায়গায় এসে পড়েছি সামনে এগোলেও বিপদ, ফিরে গেলেও বিপদ। কারণ এটা জঙ্গলের একদম গভীরে, ভাল্লুক যেকোনো দিক থেকেই আসতে পারে, অতএব চলো সামনে এগোই। কিছুটা এগিয়ে দূরে ঘন জঙ্গলের ভিতর কালো একটা কিছু ঘনীভুত হয়ে আছে দেখলাম, বুঝতে বাকি রইলো না এটা কি। এবার আরো সাবধানে এগোচ্ছি, এখানে পথ বলতে কিছুই নেই, জঙ্গল সরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। তার উপর সন্ধ্যা নেমে আসছে, জঙ্গলে সন্ধ্যা আগে নামে, গা টা ছমছম করছে একটু, চিতা, নেকড়েও ঘাপটি মেরে থাকতে পারে এই অন্ধকারে। সামনে একটা ছোটো বাঁক, ওটা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েই আমরা বাক্রুদ্ধ। এটা কোথায় এসে পড়লাম! সামনে একদম বড়ো তিনটে গুহা, আমাদের থেকে দূরত্ব মাত্র ১০-১৫ হাত। গুহার ভিতরটা এতটাই গভীর যে দিনের বেলাতে সূর্যের কড়া রোদেও ঠিক করে আলো পৌছয় কিনা সন্দেহ আছে। আরে! ওই তো একটা ভাল্লুক গুহায় ঢুকলো। ভাল্লুকের ঘ্রানশক্তি সবচেয়ে বেশী, ওরা আমাদের উপস্থিতি বুঝতে পেরেছে। গুহার আশেপাশের গাছগুলো থেকে হঠাৎ ঝুপ-ঝাপ করে লাফানোর আওয়াজ। গল্পের গরু গাছে ওঠে কিন্তু ভাল্লুক নয়, বাস্তবের ভাল্লুক কিন্তু উঠতে পারে। গাছ থেকে শিকারের ঘাড়ে লাফ দিতে পারে এরা। চালক বললো "ভাগো, হাম সাবকো মার দেগা, উসকো ম্যাসুস হো গ্যায়া..."। তারপর আর কিছু মনে নেই, পুরো দেড় কিলোমিটার পথ রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে ফিরে এসেছি মহুয়া বনের অন্ধকার সরিয়ে। ফিরে এলাম গাড়ির কাছে, এসে স্থানীয় এক আদিবাসী ছেলেকে ওখানে কাঠারি হাতে আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখলাম, তার মুখে জানলাম আমরা যে পথ দিয়ে ফিরে এসছি সেই পথেই কিছুক্ষন আগে চিতাবাঘ গেছে জঙ্গলের দিকে। প্রমান চাইতে সে আমাদের বাঘের পায়ের টাটকা ছাপ দেখালো বৃষ্টি ভেজা মাটির উপর। একটা ঠান্ডা স্রোত শিড়দাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো, বাঘটা আমাদের পিছু ধাওয়া করেনি তো? হয়তো অতজনকে দেখে আর এগোয়নি আমাদের দিকে। আর কিছু ভাবতে পারছি না, তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে চালককে বললাম "গাড়ি ভাগাও, আন্ধেরে হো রাহা হ্যায়, হামকো ইহা সে নিকালনা চাহিয়ে..."। জন্তু জানোয়ার ছাড়াও আরো একটা ভয় আছে এই জঙ্গলে, চালক বললো জঙ্গলের রাস্তা এড়িয়ে অন্যদিক দিয়ে বেড়োবে। সামনে মিলিটারি চেকপোস্ট পেড়িয়ে লৌহখনির পাশ দিয়ে চললাম হোটেলের উদ্দেশ্যে। দূরে মহুয়া বনের মাথায় আকাশের কোলে পূর্নিমার চাঁদের হাসি।