Sunday, October 8, 2017

মহুয়া বনের অন্তরে

চিত্রঃ- কিরিবুরু জঙ্গল
ঝাড়খণ্ডের কিরিবুরু, পাহাড়ের মাথায় ছোট্ট একটা শহর বলা যেতে পারে। সেখানকার আবহাওয়া, পরিবেশ সবই আমাকে মুগ্ধ করেছে। এই শহরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এখানে জল, বিদ্যুৎ, যাতায়াত সবই ফ্রী। শহর থেকে অদূরেই সারান্ডা ফরেস্ট, এই জঙ্গলে সাধারণভাবে ঢোকার অনুমতি নেই। তার জন্য নিজের পরিচয়পত্র জমা করে বিশেষ আপিল করে তবেই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিসারদের থেকে অনুমতি পাওয়া যায়। সারান্ডা ফরেস্টের ভিতরই রয়েছে Steel Authority of India Ltd. (SAIL)-এর নিজস্ব কারখানা আর তাদের নিজস্ব যাতায়াতের গাড়ি, যেগুলো এখানকার সাধারণ মানুষকে বিনামূল্যেই তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। এই কোম্পানি নিজেরা বিদ্যুতও উৎপাদন করে থাকে, নিজেদের প্রয়োজনমত বিদ্যুৎ নিয়ে বাকি অতিরিক্ত বিদ্যুৎ এখানের লোকালয়ে, বিশেষ করে সরকারি অফিসগুলিতে বিনামূল্যেই বণ্টন করে দেয়। এই শহর আসলে লোহার শহর, রাস্তাঘাট যেদিকেই চোখ যায় সব জায়গাতেই কাঁচা লোহা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। শোনা যায় আজ থেকে বেশ কয়েক দশক আগে এখানকার মানুষ সেই লোহা কুড়িয়ে বিক্রি করেই বেশ মোটা অঙ্কের টাকা উপার্জন করে ফেলেছে, তবে এখন সে'সব বন্ধ হয়েছে সরকারের হস্তক্ষেপে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে লৌহখনি, আর বিছানো রয়েছে রেলপথ, খনি থেকে লোহা তুলেই সরাসরি সেগুলো উপযুক্ত স্থানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এই ব্যবস্থা। জঙ্গলের ভিতর অধিকাংশ এলাকা জুড়েই পলাশ, পাইন, শাল ও মহুয়ার ঘন বন। এই ঘন জঙ্গলে সূর্যের আলো ঠিকঠাক মাটি পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না, তাই বেঁচে থাকার সংগ্রামে প্রতিটা গাছই ভীষণ লম্বা, তাদের মধ্যে প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধ চলে সূর্যের আলো শিকারের। রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর সিংহ বাদে প্রায় সব রকমেরই হিংস্র জীবজন্তু রয়েছে এই জঙ্গলে। মহুয়ার বন বেশী থাকায় ভাল্লুকের সংখ্যা একটু বেশীই, কারণ ভাল্লুক মহুয়ার রস খেতে ভালবাসে। এই লোহার শহরে মাটির বড়োই অভাব, চারিদিকে লোহা মিশ্রিত কাঁকুড়ে লালমাটি। তবে সেই অভাব দূর করতে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। ভাবছেন মাটি নিয়ে কি হবে? সেকি, মাটি ছাড়া চাষবাস হবে কিকরে! তাই এখানকার চাষ-আবাদ পদ্ধতিও বেশ অদ্ভুত (ঝুম চাষ পদ্ধতি), জঙ্গলের কিছুটা অংশ আগে বেছে নেওয়া হয় চাষ-আবাদের জন্য তারপর সেখনাকার গাছগুলোর গোরার কাছে কিছুটা অংশ ফুটো করে ফাঁপা করে দেওয়া হয় এবং সেগুলোকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে দেওয়া হয়। গাছগুলি মরে গিয়ে শুকিয়ে গেলে সেগুলিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় এবং তারপর সেগুলো পুড়ে ছাই হয়ে কাঁকুড়ে মাটির উপর পুরু একটা আস্তরণ ফেলে জমা হয়, আর তার উপরেই হয় চাষ-আবাদ। আর যেখানে চাষ-আবাদ হয় তার আশেপাশেই বিশাল বিশাল গাছের উপর ঘর বানিয়ে মশারি খাটিয়ে বাস করেন কিছু মানুষ, পোকামাকড়ের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য মশারি আবশ্যক। এই মানুষগুলি ফলনের সময় রাত জেগে পাহারা দেন যাতে হাতি এসে ফসল নষ্ট না করে। জঙ্গলের ভিতর গাড়ি নিয়ে বেড়াতে গেলে চোখে পড়বে কাঁচা রাস্তার আশেপাশে এখানকার মানুষদের গ্রাম, পর্যটকদের দেখে হাসিমুখে "টাটা" দেয় কিছু বাচ্ছা আদিবাসী সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা অর্থাৎ তারা শুভ যাত্রা কামনা করে, আর তারপর গাড়ির পিছনে ওরা ছুটে আসে। সঙ্গে যদি ভালোমন্দ কিছু খাবার থাকে ওদের হাতে তুলে দিলে অথবা ওদের হাতে কিছু টাকা পয়সা দিলে ওদের মুখে যে সরল হাসিটা দেখা যায় তার থেকে পরম আনন্দের কিছু হয়না। এই জঙ্গলের ভিতর অভাবের সঙ্গে লড়াই করেই ওরা প্রতি মুহূর্তে বড়ো হচ্ছে এবং চাষ-আবাদ করে ওদের বাবা-মায়েরা অন্ন তুলে দিচ্ছেন সেখানকার সাধারণ মানুষের মুখে। আসলে ওদের জনজীবন জঙ্গলের অদৃশ্য কাঁটাতারেই বন্দী, জঙ্গলের পথ পেড়িয়ে শহরে যাওয়া বেশ কঠিন, তারা লোকালয়ে একসাথে হয়ে বিভিন্ন উৎসবও পালন করে থাকেন। পর্যটকরা জঙ্গলে বিপদে পড়লে তারা নিমেশে ঝাঁপিয়ে পড়েন সাহায্যের জন্যে। তাদের মধ্যে জাত-ধর্মের কোনও ভেদাভেদ নেই, তারা একটাই কথা জানে, তারা প্রত্যেকে মানুষ, আর জঙ্গলের ভিতর প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে চাষ-আবাদ করে সাধারণ মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিয়ে সেই মানবিকতার চূড়ান্ত প্রমান দিয়ে চলেছেন প্রতি মুহূর্তে। ইচ্ছে রইলো এই জঙ্গলে আবার ফিরবো, সঙ্গে কুড়িয়ে নিয়ে আসবো আরও অনেক রোমাঞ্চ।

No comments:

Post a Comment