Sunday, October 8, 2017

ভাল্লুকের সন্ধানে


চিত্রঃ- মাঝখানে অন্ধকারের কুণ্ডলী পাকানো ভাল্লুকের গুহা
বাইরে বেড়াতে গেলে নিজেরা রান্না করে খাওয়ার একটা আলাদা মজা আছে। এবারেও জঙ্গলে গিয়ে নিজেরা রান্না চাপালাম, ভাত আর বাজার থেকে কিনে আনা দেশী মুরগীর মাংস। জঙ্গলে জলের খুব সমস্যা তাই সেই অসুবিধা দূর করতে ঝর্নার কাছেই রান্না করা হল। জল বেশ স্বচ্ছ এবং গাড়ির চালক জানালো এটা পানের যোগ্য। একদম ঘন জঙ্গল, জনবসতি বেশ দূরে এখান থেকে, ভীষন সাংঘাতিক যায়গা, বন্য জন্তু জানোয়ারের বাস এখানে। তবে জন্তু জানোয়াররা অবশ্য এখানকার মানুষকে ভয় পায়, কারণ এখানকার মানুষও বেশ অভ্যস্ত এই জনজীবনে, তারা নিমেষে কাবু করতে পারে বন্য জীবজন্তুকে। এদিকে আমাদের রান্না হচ্ছে, ভাত প্রায় হয়ে এসেছে, জায়গাটা যে সাংঘাতিক তার প্রমান পেলাম আশেপাশেই কোথাও একটা ভাল্লুকের গর্জন শুনে। চালক জানালো ভাল্লুক মাংসের গন্ধ পেয়েছে তাই গর্জন করছে, আশেপাশেই আছে যেকোনো মুহুর্তে এখানে চলে আসতে পারে। তবে আমরা সাহস করে সেখানেই রয়ে গেলাম, রান্না শেষে খাওয়াদাওয়া সেরে ভাল্লুকের গুহা দেখতে যাবো। কিন্তু প্রকৃতি আমাদের সাথ দিলো না, হঠাৎই ঝেঁপে বৃষ্টি আর সঙ্গে আকাশের বুক চিঁরে নেমে আসছে বিদ্যুতের ঝলকানি আর মেঘের গর্জন। নিঃস্তব্ধ জঙ্গলের ভিতর মেঘের গর্জনটা আরও ভয়ঙ্কর লাগছে। তাড়াতাড়ি সমস্তকিছু গুছিয়ে কোনও মতে গাড়িতে উঠলাম, যে করেই হোক এখান থেকে বেড়োতে হবে। এক জায়গায় রাস্তার উপর দিয়ে ঝর্নার জল বয়ে গেছে, বৃষ্টিতে এই রাস্তায় ধস্ নামতে পারে যেকোনো মুহুর্তে। তবে ভাগ্য ভালো জায়গাটা উতরে গেলাম, কাছেই একটা সরকারী বিশ্রামাগারে গিয়ে উঠলাম, একদম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ডেকরেশনে ফাইভ স্টার হোটেলকেও হার মানাবে, জঙ্গলের একদম কোলেই। তবে আমাদের কাছে স্পেশাল পারমিশন থাকার কারণে সেখানে ঢুকতে কোনও অসুবিধা হল না। ওখানে গিয়ে ভিতরেই বাকি রান্নাটুকু সেরে ফেলা হল, ওখানকার রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বে যিনি আছেন পাশেই মিলিটারি ক্যাম্প থেকে প্রয়োজনীয় পানিও জলের ব্যবস্থা করলেন। রান্না শেষে আমরা সবাইমিলে একসাথেই খেতে বসলাম টেবিলে। খেয়ে উঠতে উঠতে বেলা গড়িয়ে গেলো, ঘড়ির কাঁটা বলছে সাড়ে চারটে। ওখানকার রক্ষীকে কিছু বকসিস্ দিয়ে বেড়োলাম, এবার যাবো ভাল্লুকের গুহায়। যাওয়ার পথে মিলিটারি চেকপোস্টে কর্তব্যরত অফিসাররা জানান সামনে কিছুটা এগিয়েই বিশাল এক গাছ রাস্তার উপর পড়ে আছে, গাড়ি যাবে না হয়তো, তবে উনারা আমাদের বাধা দেননি, কেবল সাবধান করলেন। কিছুটা পথ এগিয়ে দেখলাম সত্যিই তাই, প্রকান্ড এক গাছ উপরে পড়ে আছে রাস্তার উপর। গাড়ির চালক জানালো বাকি দেড় কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটেই যেতে হবে। সন্ধ্যা নামার মুখে ওখানে না যাওয়াই ভালো, তার উপর ঘন জঙ্গলে অন্ধকারটা আরও ঘনিয়ে উঠেছে, প্রচুর ভাল্লুক আছে এই অঞ্চলে, সঙ্গে চিতাও আছে। যেকোনো মুহুর্তে অ্যাটাক করতে পারে, গতমাসেই একজনকে ভাল্লুকে মেরে ফেলেছে, আর এখন ভাল্লুকদের ডেরায় ফেরার সময়, তাই ফিরে যাওয়াটাই ভালো হবে। আমরা একটু অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়, তাই ফিরে আসতে মনটা ঠিক মানলো না। আমাদের বাকি সঙ্গীদের কয়েকজন বললো ফিরে যেতে আবার কয়েকজন বললো ভাল্লুকের গুহায় যাবে। তাই শেষে ঠিক হলো আমরা চারজন সঙ্গী মিলে জঙ্গলে যাবো, সঙ্গে গাড়ির চালক যাবে আর বাকিরা গাড়িতেই অপেক্ষা করবে আমাদের। যেমন প্ল্যান তেমনই কাজ, চালক বলে দিলো বিপদ বুঝলেই দৌড়াতে, এখানে কেউ কারোর জন্য অপেক্ষা করবে না। জঙ্গলের দিকে রওনা হলাম, প্রায় এক কিলোমিটার গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়লো ভাল্লুকের থাবার টাটকা ছাপ, কিছুক্ষন আগেই এখানে ভাল্লুক এসেছে। একটু ভয় পেলাম, থ্রিলটাও বেশ কয়েকগুন বেড়ে গেলো সঙ্গে উৎসাহটাও। এবার চারদিকে নজর রেখে ধীরে ধীরে এগোচ্ছি, এমন সময় কিছুটা দূরেই ভীষন শব্দে একটা ভাল্লুকের গর্জন। যত পথ এগোচ্ছি তত ভয় আর উৎসাহ সমানুপাতে বাড়ছে মনের ভিতর। একটু এগোতেই হঠাৎ কিছুটা দূরেই একটা গাছ থেকে ঝুপ করে কিছু একটা ঝাঁপ দিলো। সবাই থমকে গেলাম, একজন বললো আর এগোনো ঠিক হবে না। কিন্তু আমরা এখন এমন জায়গায় এসে পড়েছি সামনে এগোলেও বিপদ, ফিরে গেলেও বিপদ। কারণ এটা জঙ্গলের একদম গভীরে, ভাল্লুক যেকোনো দিক থেকেই আসতে পারে, অতএব চলো সামনে এগোই। কিছুটা এগিয়ে দূরে ঘন জঙ্গলের ভিতর কালো একটা কিছু ঘনীভুত হয়ে আছে দেখলাম, বুঝতে বাকি রইলো না এটা কি। এবার আরো সাবধানে এগোচ্ছি, এখানে পথ বলতে কিছুই নেই, জঙ্গল সরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। তার উপর সন্ধ্যা নেমে আসছে, জঙ্গলে সন্ধ্যা আগে নামে, গা টা ছমছম করছে একটু, চিতা, নেকড়েও ঘাপটি মেরে থাকতে পারে এই অন্ধকারে। সামনে একটা ছোটো বাঁক, ওটা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েই আমরা বাক্রুদ্ধ। এটা কোথায় এসে পড়লাম! সামনে একদম বড়ো তিনটে গুহা, আমাদের থেকে দূরত্ব মাত্র ১০-১৫ হাত। গুহার ভিতরটা এতটাই গভীর যে দিনের বেলাতে সূর্যের কড়া রোদেও ঠিক করে আলো পৌছয় কিনা সন্দেহ আছে। আরে! ওই তো একটা ভাল্লুক গুহায় ঢুকলো। ভাল্লুকের ঘ্রানশক্তি সবচেয়ে বেশী, ওরা আমাদের উপস্থিতি বুঝতে পেরেছে। গুহার আশেপাশের গাছগুলো থেকে হঠাৎ ঝুপ-ঝাপ করে লাফানোর আওয়াজ। গল্পের গরু গাছে ওঠে কিন্তু ভাল্লুক নয়, বাস্তবের ভাল্লুক কিন্তু উঠতে পারে। গাছ থেকে শিকারের ঘাড়ে লাফ দিতে পারে এরা। চালক বললো "ভাগো, হাম সাবকো মার দেগা, উসকো ম্যাসুস হো গ্যায়া..."। তারপর আর কিছু মনে নেই, পুরো দেড় কিলোমিটার পথ রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে ফিরে এসেছি মহুয়া বনের অন্ধকার সরিয়ে। ফিরে এলাম গাড়ির কাছে, এসে স্থানীয় এক আদিবাসী ছেলেকে ওখানে কাঠারি হাতে আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখলাম, তার মুখে জানলাম আমরা যে পথ দিয়ে ফিরে এসছি সেই পথেই কিছুক্ষন আগে চিতাবাঘ গেছে জঙ্গলের দিকে। প্রমান চাইতে সে আমাদের বাঘের পায়ের টাটকা ছাপ দেখালো বৃষ্টি ভেজা মাটির উপর। একটা ঠান্ডা স্রোত শিড়দাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো, বাঘটা আমাদের পিছু ধাওয়া করেনি তো? হয়তো অতজনকে দেখে আর এগোয়নি আমাদের দিকে। আর কিছু ভাবতে পারছি না, তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে চালককে বললাম "গাড়ি ভাগাও, আন্ধেরে হো রাহা হ্যায়, হামকো ইহা সে নিকালনা চাহিয়ে..."। জন্তু জানোয়ার ছাড়াও আরো একটা ভয় আছে এই জঙ্গলে, চালক বললো জঙ্গলের রাস্তা এড়িয়ে অন্যদিক দিয়ে বেড়োবে। সামনে মিলিটারি চেকপোস্ট পেড়িয়ে লৌহখনির পাশ দিয়ে চললাম হোটেলের উদ্দেশ্যে। দূরে মহুয়া বনের মাথায় আকাশের কোলে পূর্নিমার চাঁদের হাসি।

No comments:

Post a Comment