অনিমেশ আমার ভীষণ ভালো বন্ধু, একসাথে রোজই সন্ধ্যায় মাঠে আড্ডা দিই বেশ রাত অব্ধি। কত কথা জানে ও, ভীষণ সাহসী ছেলে... ভূতুরে কোনও ব্যাপারে অথবা হন্টেড প্লেসে যেতে হলে এক পায়ে রাজি। আর যাই হোক ও আমার মতো ভীতু নয়, অন্ধকারে নিজের ছায়া দেখেই মুখ ফেরাই... সেটা ও বেশ ভালো মতোই জানে। অনেক বিষয়ে অনেক মজা করলেও এসব নিয়ে কখনও তাই আমার সাথে মজা করে না। যাই হোক, থাক সেসব কথা...। এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় দক্ষিণা হাওয়ার কোলে হেলান দিয়ে আমরা মাঠের মাঝে আড্ডা দিচ্ছি। সবে এক ঘণ্টা হয়েছে।"চল, এবার ওঠা যাক", বলে অনিমেশ উঠে দাঁড়ালো মাঠের আড্ডা থেকে।
"কিন্তু এখন তো সবে সাতটা বাজে... এতো তাড়াতাড়ি... কোথায়..." জিজ্ঞেস করলাম।
কথা শেষ করার আগেই অনিমেশ বলল "একটা জায়গায় যাবো... তুই যাবি?"
এমনিতেই কোনও কাজ নেই, এখন বাড়ি যেতেও ভালো লাগছে না... বললাম "চল যাই... এমনিতেও তো কিছু কাজ নেই এখন।"
আমিও উঠে দাঁড়ালাম, অনিমেশ মাঠের পাশের রাস্তার দিকে ইশারা করে বলল "চল হাঁটা লাগা..."। আমি জিজ্ঞেস করলাম "কোথায় যাবি তো বল এই সন্ধে বেলায়, মাঠের পাশে রাস্তাটা শুনেছি ভালো না..."
অনিমেশ আবার কথা থামিয়ে বলে উঠলো "চল না, এই কাছেই..."
আমি কথা না বাড়িয়ে চললাম, একটু একটু করে এগিয়েই চলেছি... মাঠের পাশের বাঁশবাগান পেড়িয়ে অনেকটা দূরে চলে এসেছি... ওই দূরে দেখা যায় হাইরোডে আলো জ্বেলে ভীষণ বেগে বেড়িয়ে যাচ্ছে লরিগুলো আর হাওয়ার "ভোঁওওওওও...ভোঁওওওওও..." শব্দ ভেসে আসছে। অনিমেশ ওদিকে হাত দেখিয়ে বলল "চল ওদিক থেকে ঘুরে আসি..."
কেমন একটা খটকা লাগলো, ওকে বললাম "ওখানে কি আছে? হাইরোডের ধারে ওই জায়গাটা বেশ শুনশান... দোকান-পাট কিছুই নেই... ওদিকে গিয়ে..." আবার কথা থামিয়ে বলল "ধুর্, চল না, গেলেই দেখতে পাবি..." আমি বোবার মতো মুখ বন্ধ করে চললাম। অনেকটা কাছে এসে গেছি, এখান থেকে মাত্র কয়েক পা এগোলেই হাইরোড, একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে অনিমেশ বলল "নে বস্ এখানে, আমার একটা কাজ আছে মিটিয়ে আসি..."
আমি বললাম, "কি কাজ রে এই নির্জন এলাকায়, যাই না!"
অনিমেশ বিরক্তির ভঙ্গিতে বলল "বস্ না চুপ করে, বেকার গিয়ে কি করবি... আমি আসছি একটু পরেই।"
অগত্যা বসে রইলাম একা। অমাবস্যার রাত, আকাশে চাঁদ নেই তাই আলো ক্ষীণ। স্ট্রীট লাইটের হলুদে-লাল আভায় মাথার উপর আকাশ একেবারে স্নান করে বসে আছে। আর সেই আভায় গা ঢাকা দিয়ে জেগে রাত পাহারা দিচ্ছে অজস্র তারা। পাশেই একটা ছোট তেঁতুল গাছের সমস্ত শরীর আলোয় মুড়ে দিয়েছে জোনাকির দল। দক্ষিণা হাওয়া যখন বইছে কেমন নড়ে চড়ে উঠছে এই জোনাকির দল দিয়ে আবার কেমন এলোমেলো হয়ে সেই গাছের পাতায় গিয়ে বসছে। এই হাওয়ায় বেশ আলস্য জাগছে শরীরে, মনে হচ্ছে এই ফাঁকা মাঠেই শুয়ে থাকি আকাশের দিকে চোখ রেখে, যদি একটা দুটো তারা খসে পরে তো কিছু ইচ্ছে পূরণ হতে পারে। বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেলো, অনিমেশ আর আসে না। কি জানি কি কাজে আটকে পড়েছে, আমার বেশ ভালোই লাগলে। কেমন একটা নস্টালজিয়া ভাব জাগছে মনের ভিতর। কত পুরনো কথা মনে পরে যাচ্ছে, কলেজ লাইফের না হওয়া প্রেম, প্রাক্তন প্রেমিকার অভিমান, আরও কত সব কথা...। এই নস্টালজিয়া থেকেই কখনও বা একটা ফ্রিকশানও সৃষ্টি হচ্ছে মনের ভিতর। মনে হচ্ছে ওই দূরে আকাশের কোলে তারাদের ভিতরেও যেন অন্য আরেক নক্ষত্রজগৎ আছে। সেখানে আমারই মতো কোনও মানুষ হয়তো বসে আছে আর একভাবে তাকিয়ে আমার মনের গল্পগুলো সব পড়ে ফেলছে। অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করছে কোনও একদিন সেই ভিনগ্রহী মানুষের সাথে দেখা করার। হয়তো বা সেও আমারই মতো ভাবছে ভিন গ্রহে বসে, হয়তো বা সে জানেই না আমি এখানে তার অপেক্ষা করছি, এরকম কত চিন্তা মাথায় ঘুরছে। এক অন্যরকম অনুভূতি, যার কোনও লজিক নেই, শুধু আবেগ আছে। মনে হচ্ছে যদি গান লিখতে পারতাম, এই রাতেই হয়তো দু-তিনটে গান আর গোটা চারেক কবিতা নামিয়ে ফেলতাম, কিন্তু আমি তো সেসব কিছুই পারি না। কেমন এক অদৃশ্য নেশায় মগ্ন হয়ে আছি। হঠাৎ গায়ে একটা ঠেলা দিয়ে "কিরে! বাড়ি যাবি না? রাত হল তো!"
"কে? ওহ! অনিমেশ তুই..." চমকে উঠলাম। "হ্যাঁ যাবো তো, তুই-ই তো কোথায় চলে গেলি এক্ষুনি আসছি বলে।" বলে ঘড়ির দিকে তাকালাম। "হ্যাঁ! এর মধ্যে সাড়ে ন'টা বেজে গেলো... চল চল তাড়াতাড়ি চল..."
আমি একাই বকে গেলাম, অনিমেশ চুপচাপ হাঁ করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। আলস্য ভাঙিয়ে উঠতে একটু আস্তেই উঠছি, এবার অনিমেশ মুখ খুললো "তাড়াতাড়ি চল, অনেক কাজ..." বলেই আমাকে হাতটা ধরে তুলল। যে পথে এসেছি সেই পথেই ফিরবো, হাঁটা শুরু করার আগে অনিমেশ আমাকে একবার থামালো। অদূরে হাইরোডের দিকে হাত দেখিয়ে বলল "ওই যে দেখছিস ওখানে রেলিংটা ভাঙা মতো, কোনোদিন সন্ধ্যাবেলা ওখানে রাস্তা ক্রস করবি না...।" আমি জিজ্ঞেস করতে যাবো "হঠাৎ এরকম অদ্ভুত কথা বলছিস কেন রে..."। অনিমেশ রেগে গিয়ে বলল "যেটা বলছি সেটা শোন, মেলা কথা বাড়াস না... গতকাল আমাকে এক বন্ধু বলেছিল এই কথাটা। তোর ভালো চাই তাই তোকেও বললাম, কেন কি বৃত্তান্ত অতো জানি না ভাই..."। ঠিক হ্যায়, আমি এমনিতেই ভীতু মানুষ, কি বলতে কি গল্প শুনিয়ে দেবে এখুনি তারপর আবার ভয়ে বাঁশবাগানের পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবো না, একেই অমাবস্যার রাত। হাঁটা লাগালাম আমি আর অনিমেশ। অবশেষে আবার মাঠে গিয়ে পৌঁছলাম। আমার আর অনিমেশের বাড়ি দুই প্রান্তে, অতএব এবার রাস্তা বদল। অনিমেশ অন্যদিকে চলে গেলো, আমি আমার বাড়ির রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। যাওয়ার আগে বলে গেলো, "যেটা বললাম মনে থাকে যেন... আর হ্যাঁ, কাল তো তোর চাকরির ইন্টার্ভিউ আছে। অল দ্য বেষ্ট।"। "থ্যাঙ্কস" বলে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে শুয়ে পড়লাম। কেমন একটা অস্বস্তি কাজ করছে মনের ভিতর, কেন জানি না। পরেরদিন সকালে উঠে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম চাকরির পরীক্ষা দিতে। যাওয়ার পথে ষ্টেশন থেকে একটা খবরের কাগজ কিনে ব্যাগে ভরে নিলাম। নির্দিষ্ট সেন্টারে পৌঁছে মনে হল ইন্টার্ভিউতে তো আবার মাঝে মাঝে কারেন্ট আফ্যেয়ার নিয়ে প্রশ্ন করে তাই কাগজটা একটু দেখে নিই এবার। কোনোক্রমে প্রথম পাতাটা খুলতে যাবো, আমার ডাক এলো ভিতর থেকে। কাগজটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ভিতরে গেলাম। ইন্তারভিউয়ার প্রশ্ন করলেন, আমিও ঝটপট উত্তর দিয়ে বেশ ভালো মতো ক্র্যাক করলাম ইন্টার্ভিউটা। ভাগ্যক্রমে কারেন্ট আফ্যেয়ার নিয়ে সেভাবে কিছু ধরে নি, ওই কদিন আগে একটা রাজনৈতিক ঝামেলার উপর প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে কয়েকটা প্রশ্ন করেছিলো মাত্র। বড্ড ক্লান্ত লাগছে শরীরটা, পাশেই একটা চায়ের দোকানে গিয়ে চা খাচ্ছি। পাশেই টেবিলের উপর রাখা বাংলা-ইংরেজি খবরের কাগজ, চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে ইংরেজি কাগজটা হাতে নিতেই একটা ধাক্কা। প্রথম পাতায় বড়ো বড়ো অক্ষরে ছাপানো অনিমেশের মৃত্যুর খবর। স্থানঃ- কাল রাতের সেই হাইরোডের বুকে রেলিং ভাঙা জায়গাটা, সময়ঃ- গতকাল রাত সাড়ে আটটার আসেপাশে। কেমন যেন শিউড়ে উঠলাম, এই প্রচণ্ড গরমেও একটা ঠাণ্ডা স্রোত। সাব-হেডিং-এ মাঝারি হরফে লেখা "Don't Cross my road".
No comments:
Post a Comment